নিজস্ব প্রতিবেদক ॥ করোনা মহামারীর প্রাদুর্ভাব রুখতে দেশের সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে স্বাভাবিক শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ গত চার মাস যাবত। তবে এই দীর্ঘ বন্ধে বরিশালের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান শুরু করেছে অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম। বর্তমান পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবনের দীর্ঘসূত্রিতা রোধে এ কার্যক্রম ইতোমধ্যে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। অনলাইনে বিভিন্ন উপায়ে স্বাভাবিক সময়ের মতো ক্লাস-পরীক্ষা শুরু করেছে এখানকার কয়েকটি প্রতিষ্ঠান। তবে নতুন বাস্তবতায় এই কার্যক্রমের কিছু সমস্যা ও সংকট সামনে এসেছে। যেগুলো সমাধান করতে পারলে অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম থেকে ভালো ফলাফল আসবে বলে মনে করেন অনেকে। বরিশাল বিভাগের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গুলোর মধ্যে সর্বপ্রথম জাহানারা ইসরাইল স্কুল অ্যান্ড কলেজে অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয়। প্রতিষ্ঠানটির অনলাইন সার্ভারে প্রতিটি শিক্ষার্থীদের জন্য তৈরি করা আলাদা ইউজার আইডিতে নির্দিষ্ট পাসওয়ার্ড ব্যবহার করে ঘরে বসেই সবাই ক্লাস-পরীক্ষায় যুক্ত হতে পারছে।
এসব তথ্য নিশ্চিত করে প্রতিষ্ঠানটির প্রধান শিক্ষক সত্যজিৎ রায় বলেন, যেহেতু করোনা পরিস্থিতি সহসাই স্বাভাবিক হবার কোন লক্ষণ ছিল না তাই শিক্ষার্থীদের মূল্যবান শিক্ষা জীবনের কথা মাথায় রেখে আমরা গত ১২ এপ্রিল থেকে অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করি। বর্তমানে অনলাইনে নেওয়া ক্লাস এবং পরীক্ষা গুলোতে স্বাভাবিক সময়ের মতোই প্রায় শতভাগ উপস্থিতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এদিকে গত মে মাস থেকে অনলাইনে শুধু ক্লাস নেয়া শুরু করে দক্ষিণবঙ্গের সবচেয়ে বৃহৎ উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সরকারি ব্রজমোহন (বিএম) কলেজ। সেখানকার উচ্চ মাধ্যমিক (এইচএসসি), অনার্স – মাস্টার্স এবং ডিগ্রির সকল শিক্ষার্থীদের জন্য বিভিন্ন মাধ্যমে নিয়মিত অনলাইন ক্লাস নেয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছে প্রতিষ্ঠানটির কর্তৃপক্ষ।
এ ব্যাপারে কলেজটির শিক্ষক পরিষদের সাধারণ সম্পাদক আল আমিন সরোয়ার বলেন, মে মাস থেকে রুটিন করে ফেসবুক লাইভ,ভিডিও ক্যামেরায় লেকচার রেকর্ড কিংবা জুম অ্যাপ ব্যবহার করে সবকটি বিভাগে ক্লাস চালু রাখা হয়েছে। প্রতিটি লাইভ (সরাসরি) ক্লাসে শতকরা ৪০ শতাংশ উপস্থিতি নিশ্চিত হয়েছে। তবে যারা সরাসরি লাইভ ক্লাসে যুক্ত হতে পারছে না তাদের জন্য পরবর্তীতে নির্দিষ্ট অনলাইন প্লাটফর্ম থেকে রেকর্ডকৃত ক্লাসটি দেখে নেবার সুযোগ থাকে।
তিনি উল্লেখ করেন, সকল শিক্ষার্থী যেন তার সুবিধাজনক উপায়ে ক্লাস লেকচারগুলো পেতে পারে সে ব্যাপারে শিক্ষকগণ আন্তরিকতার সঙ্গে তদারকি করেন। এই তদারকির ফলে দূরে থেকেও আমাদের শিক্ষক শিক্ষার্থীদের মধ্যকার যোগাযোগ নিয়মিত হয়েছে। যে কারণে চলমান মহামারীতে অলস ভাবে বসে থেকে মানসিকভাবে বিপর্যয়ের হাত থেকে অনেকে রক্ষা পেয়েছে বলেই মনে করছি। অন্যদিকে দীর্ঘ দুই মাস পরীক্ষা মূলক অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা শেষে গত ১৫ জুলাই থেকে চূড়ান্তভাবে অনলাইন ক্লাস কার্যক্রম শুরু করেছে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়। এ ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয়টির উপাচার্য ড. মোঃ ছাদেকুল আরেফিন বলেন, পরীক্ষামূলক অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে আমরা প্রাথমিকভাবে শিক্ষার্থীদের কাছে এই কার্যক্রমকে পরিচিত করেছি। পরবর্তীতে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের (ইউজিসি) নির্দেশনা অনুযায়ী গত ১৫ জুলাই থেকে প্রতিটি বিভাগে অনলাইনে নিয়মিত ক্লাস কার্যক্রম শুরু হয়েছে।
তিনি জানান, তাঁর দায়িত্ব নেবার পূর্বের নানা জটিলতায় প্রতিষ্ঠানটির বিভিন্ন বিভাগে সেশনজট বিদ্যমান। এর মধ্যে করোনাকালীন সময়ে দীর্ঘদিন শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবন দীর্ঘায়িত হবার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছিল। যেটা প্রতিরোধে অনলাইন ক্লাস ভূমিকা রাখবে বলে ধারণা তাঁর। তিনি উল্লেখ করেন, বিভাগগুলো থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী অনলাইন লাইভ ক্লাসগুলোতে প্রায় ৬৫ শতাংশ শিক্ষার্থী উপস্থিত হচ্ছে। অন্যদিকে যেসব ক্লাস রেকর্ড করে বিভিন্ন অনলাইন প্লাটফর্মে উন্মুক্ত করা হচ্ছে সেগুলো ৯০ শতাংশের বেশি শিক্ষার্থীর কাছে পৌঁছাচ্ছে।
তবে এই শিক্ষা কার্যক্রমের কিছু সমস্যাও সামনে এসেছে বেশ জোরেশোরে। যেগুলো উত্তরণ করা গেলে সকল শিক্ষার্থীদের অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করা সহজ হবে বলে মনে করেন অনেকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ড. মোঃ খোরশেদ আলম বলেন,অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত হতে শিক্ষার্থীদের প্রধান সমস্যা ইন্টারনেট নেটওয়ার্ক এর দুর্বল গতি। এছাড়া অনেকেরই স্মার্ট ফোন কিংবা ল্যাপটপ নেই। এবং অনলাইনে যুক্ত হতে যে ডাটা (ইন্টারনেট প্যাকেজ) কিনতে হচ্ছে তা ব্যয়বহুল। তিনি এজন্য সরকারের প্রতি শিক্ষার্থীদের জন্য ‘সুদ মুক্ত শিক্ষা ঋণ’ দাবি করেছেন। নগরীর একটি নামকরা বেসরকারি বিদ্যালয়ে ২য় শ্রেণীতে পড়েন বান্দ রোড এলাকার বাসিন্দা খান রুবেলের একমাত্র সন্তান। তিনি জানান, গত দুই মাস যাবত তার সন্তানের স্কুল থেকে অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। কিন্তু এই কার্যক্রমে ক্লাস-পরীক্ষা নিয়মিত না হলেও প্রতি মাসে স্কুলের বেতন সম্পূর্ণটাই নিয়মিত পরিশোধ করতে হচ্ছে। অন্যদিকে যতটুকু ক্লাস অনলাইনে হচ্ছে সেটার জন্য প্রয়োজনীয় ইন্টারনেট কিনতে চড়া মূল্য দিতে হচ্ছে। অন্যদিকে ক্লাস চলাকালীন বিদ্যুৎ বিভ্রাটে সংযোগ বিচ্ছিন্ন হবার ঘটনা তো আছেই। তাই এই অভিভাবক আশা প্রকাশ করেন অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার ব্যাপারে সরকার হস্তক্ষেপ করবে। বিশেষ করে শিক্ষার্থীদের জন্য সুলভ মূল্যে ইন্টারনেট পরিষেবা নিশ্চিত করতে তিনি সরকারের প্রতি আহবান জানান।
Leave a Reply